ইসলামে পুরুষের পর্দার বিধান। মাহরাম ও গায়ের মাহরাম

ইসলামে পুরুষের পর্দার বিধান। মাহরাম ও গায়ের মাহরাম

যেসব নারীকে যেসব পুরুষের বিয়ে করা স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ সেসব নারী ওইসব পুরুষদের মাহরাম। যেসব নারীকে সাময়িকভাবে বিয়ে করা একজন পুরুষের জন্য নিষিদ্ধ যেমন- নিজের স্ত্রী থাকা অবস্থায় তার বোন, ফুফু ও খালা বিয়ে করা- তারা এই পুরুষের মাহরাম নয়। পুরুষরা যেসব নারীকে বিয়ে করা বৈধ, সেসব নারী পুরুষদের গায়রে মাহরাম। অনুরূপভাবে নারীরা যেসব পুরুষকে বিয়ে করা স্থায়ীভাবে অবৈধ ওইসব পুরুষ নারীদের মাহরাম। আর নারীরা যেসকল পুরুষকে বিয়ে করা বৈধ, ওইসব পুরুষ নারীদের গায়রে মাহরাম।

ইসলামী শরীয়তে গায়রে মাহরাম পুরুষ ও নারীর মধ্যে একে অপরকে পর্দা করা ফরজ। গায়রে মাহরাম অর্থাৎ বেগানা নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করা পুরুষের জন্য হারাম। তেমনি গায়রে মাহরাম পুরুষের প্রতি দৃষ্টিপাত করা নারীর জন্য উচিত নয়। তবে অনিচ্ছায় হঠাৎ যে দৃষ্টি পড়ে যায়, সেটার কথা ভিন্ন। ইচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টিকে দীর্ঘায়িত করা হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ছতর ঢেকে রাখা ফরজ। ছতর পর্দার আওতাধীন।

পুরুষের ছতর নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত এবং নারীর ছতর মুখমণ্ডল, হাতের কব্জি এবং পায়ের পাতা ছাড়া বাকি সর্বাঙ্গ। অবশ্য মুখমণ্ডল ছতরের অন্তর্ভুক্ত না হলেও হিজাবের অন্তর্ভুক্ত। তাই নারীরা গায়রে মাহরাম থেকে নিজের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতে হবে। কারও ছতর স্পর্শ করা তো দূরের কথা দূর হতে দেখা এবং দেখানোও হারাম। অবশ্য বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন চিকিৎসার জন্য ছতরের প্রয়োজনীয় অংশ দেখানো যেতে পারে।

এছাড়াও মুসলিম নারী বিধর্মী নারীদের সাথেও পর্দা করতে হবে। নারীরা তার মাহরামের সামনে বের হতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কোনো ফিতনার আশঙ্কা থাকলে বের না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পর্দার কোনো হুকুম নেই। তবে একে অন্যের লজ্জাস্থান দেখা উচিত নয়।

নিম্নবর্ণিত নারীরা পুরুষের মাহরাম
১. মা: এ পর্যায়ে আপন মা, সৎ মা এবং দুধ মা মাহরামভুক্ত। সৎ মা’র সঙ্গে পিতার সহবাস হোক বা নাই হোক। তবে দুধ সম্পর্কিত সৎ মা, দুধ ভাইবোনের আপন মা ও দুধ মা এবং দুধ ছেলেমেয়ের আপন দাদি ও দুধ দাদি মাহরামভুক্ত নয়। এছাড়া অন্য কোনো প্রকারের মা যেমন- ধর্মীয় মা, পালক মা, চাচি ও মামি মাহরাম নয়।

আরো পড়ুনঃ  ভালোবাসা এবং প্রেমে পড়া কি একই কথা?

২. খালা: এ পর্যায়ে আপন খালা, সৎ খালা, বৈপিত্রেয় খালা, দুধ খালা অর্থাৎ দুধ মা’র আপন বোন, সৎ বোন, বৈপিত্রেয় বোন এবং দুধ বোন মাহরাম। এমনিভাবে আপন মাতা-পিতার খালা, দাদা-দাদির খালা ও নানা-নানির খালাও মাহরামভুক্ত। উল্লেখ্য যে, বৈপিত্রেয় বলতে বোঝায়, দুইজন লোক চাই পুরুষ হোক কিংবা নারী, যদি তাদের মা এক এবং বাপ ভিন্ন হয়, তাহলে সে দু’জন বৈপিত্রেয় স¤পর্কে ভাইবোন।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করতে এইখানে ক্লিক করে স্টার বাটন প্রেস করুন।

৩. ফুফু: এ পর্যায়ে আপন ফুফু, সৎ ফুফু, বৈপিত্রেয় ফুফু ও দুধ ফুফু মাহরাম। এমনি নিজের মাতাপিতার ফুফু, দাদা-দাদির ফুফু ও নানা-নানির ফুফু এভাবে যত উপরে যাক সকলেই মাহরাম। তবে বৈপিত্রেয় ফুফুর ফুফু মাহরাম নয়।

৪. বোন: এ পর্যায়ে আপন বোন, সৎ বোন, বৈপিত্রেয় বোন এবং দুধ মা’র আপন মেয়ে ও সৎ মেয়ে মাহরাম। তবে সৎ ভাইয়ের বৈপিত্রেয় বোন মাহরাম নয়। আপন ছেলেমেয়ের দুধ মা, আপন ভাইবোনের দুধ বোন, দুধ ভাইবোনের আপন বোন ও দুধ বোন মাহরাম নয়। অনুরূপ দুধ মা’র দুধ মেয়ের আপন বোন, সৎ বোন ও দুধ বোন মাহরাম নয়। তেমনি দুধ ছেলেমেয়ের আপন ফুফু ও দুধ ফুফু মাহরাম নয়। এছাড়া চাচাতো, খালাতো, ফুফাতো ও মামাতো বোন মাহরাম নয়।

৫. মেয়ে: এ পর্যায়ে আপন মেয়ে, দুধ মেয়ে ও বৈপিত্রেয় মেয়ে অর্থাৎ নিজের স্ত্রীর প্রাক্তন ঔরসজাত মেয়ে মাহরাম। অবশ্য বৈপিত্রেয় মেয়ে মাহরাম হবে যদি তার মায়ের সঙ্গে সহবাস হয়ে থাকে। আর যদি শুধু বিয়ের আকদ হয়ে থাকে, কিন্তু সহবাস না হয়ে থাকে, তাহলে স্ত্রীর প্রাক্তন মেয়ে মাহরাম নয়। বর্ণিত নারীদের অধঃস্তন নারীরাও মাহরাম। তবে দুধ ছেলেমেয়ের আপন বোন ও দুধ বোন মাহরাম নয়।

৬. পুত্রবধূ: এ পর্যায়ে আপন পুত্রের স্ত্রী, দুধ পুত্রের স্ত্রী মাহরাম। তেমনি আপন পুত্রের পুত্রের স্ত্রী এবং দুধ পুত্রের পুত্রের স্ত্রী এভাবে নিচের দিকে যতই যাক। বৈপিত্রেয় পুত্রের স্ত্রী মাহরামভুক্ত নয়। তেমনি দুধ পুত্রের পুত্রের দুধ মা ও দুধ মেয়ের মেয়ের দুধ মা মাহরাম নয়।

আরো পড়ুনঃ  ইসলামে নারীর পর্দার বিধান। মাহরাম ও গায়ের মাহরাম

৭. ভাতিজি: এ পর্যায়ে আপন ভাইয়ের মেয়ে, সৎ ভাইয়ের মেয়ে, বৈপিত্রেয় ভাইয়ের মেয়ে ও দুধ ভাইয়ের মেয়ে মাহরাম। তবে চাচাতো, ফুফাতো, খালাতো ও মামাতো ভাইয়ের মেয়ে মাহরাম নয়।

৮. ভাগিনি: এ পর্যায়ে আপন বোনের মেয়ে, সৎ বোনের মেয়ে, দুধ বোনের মেয়ে, বৈপিত্রেয় বোনের মেয়ে এবং এদের অধঃস্তন সবাই মাহরাম। চাচাতো, ফুফাতো, খালাতো ও মামাতো বোনের মেয়ে মাহরাম নয়।

৯. নাতিন: এ পর্যায়ে আপন ছেলের মেয়ে, দুধ ছেলের মেয়ে, বৈপিত্রেয় ছেলের মেয়ে, আপন মেয়ের মেয়ে, দুধ মেয়ের মেয়ে, বৈপিত্রেয় মেয়ের মেয়ে, আপন ভাইয়ের ছেলের মেয়ে, সৎ ভাইয়ের ছেলের মেয়ে, দুধ ভাইয়ের ছেলের মেয়ে, বৈপিত্রেয় ভাইয়ের ছেলের মেয়ে, আপন ভাইয়ের মেয়ের মেয়ে, সৎ ভাইয়ের মেয়ের মেয়ে, দুধ ভাইয়ের মেয়ের মেয়ে, বৈপিত্রেয় ভাইয়ের মেয়ের মেয়ে, আপন বোনের ছেলের মেয়ে, সৎ বোনের ছেলের মেয়ে, দুধ বোনের ছেলের মেয়ে, বৈপিত্রেয় বোনের ছেলের মেয়ে, আপন বোনের মেয়ের মেয়ে, সৎ বোনের মেয়ের মেয়ে, দুধ বোনের মেয়ের মেয়ে ও বৈপিত্রেয় বোনের মেয়ের মেয়ে এবং বোনের অধঃস্তন সকল নারী মাহরামভুক্ত। 

বৈপিত্রেয় ছেলের মেয়ে ও বৈপিত্রেয় মেয়ের মেয়ে হলÑ নিজের স্ত্রীর যথাক্রমে প্রাক্তন ছেলের মেয়ে এবং মেয়ের মেয়ে। এক্ষেত্রে নিজ স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস হয়ে থাকলে এরা দু’জন মাহরামভুক্ত হবে অন্যথায় নয়। তবে দুধ ছেলেমেয়ের আপন বোনের মেয়ে ও দুধ ছেলেমেয়ের দুধ বোনের মেয়ে মাহরাম নয়।

১০. দাদি: এ পর্যায়ে আপন দাদি এবং তার মা এভাবে যত উপরে যাক, সৎ দাদি, দুধ দাদি, আপন দাদি ও দুধ দাদির আপন বোন, সৎ বোন, দুধ বোন ও বৈপিত্রেয় বোন মাহরামভুক্ত। তবে দুধ চাচা ও দুধ ফুফুর আপন মা ও দুধ মা মাহরাম নয়।

১১. নানি: এ পর্যায়ে আপন নানি এবং তার মা এভাবে যত উপরে যাক, সৎ নানি, দুধ নানি, আপন নানি ও দুধ নানির আপন বোন, সৎ বোন, দুধ বোন ও বৈপিত্রেয় বোন মাহরামভুক্ত। তবে দুধ মামা-খালার আপন মা ও দুধ মা মাহরাম নয়।

আরো পড়ুনঃ  বাবা কেন সব সময় পিছিয়ে থাকে?

১২. শাশুড়ি: এ পর্যায়ে আপন শাশুড়ি ও দুধ শাশুড়ি যত উপরে যাক মাহরাম। সৎ শাশুড়ি মাহরাম নয়। তেমনি দুধ ছেলেমেয়ের আপন নানি ও দুধ নানি মাহরাম নয়।

১৩. দাদি শাশুড়ি: এ পর্যায়ে আপন দাদি শাশুড়ি ও দুধ দাদি শাশুড়ি যত উপরে যাক মাহরাম। সৎ দাদি শাশুড়ি মাহরাম নয়।

১৪. নানি শাশুড়ি: এ পর্যায়ে আপন নানি শাশুড়ি ও দুধ নানি শাশুড়ি মাহরাম। সৎ নানি শাশুড়ি, মামি শাশুড়ি, চাচি শাশুড়ি, খালা শাশুড়ি ও ফুফু শাশুড়ি মাহরাম নয়।

ইসলামী পরিবার গঠনে মাহরাম-গায়ের মাহরামের জ্ঞান থাকাটা অত্যাবশ্যক। নিচের ছবিটির মাধ্যমে আমরা আমাদের নিকট আত্নীয়দের মধ্যে কে একজন পুরুষের মাহরাম আর কে গায়ের মাহরাম তা দেখিয়েছি।

সবুজ রঙের মাধ্যমে মাহরাম ও লাল রঙের মাধ্যমে গায়ের মাহরাম বোঝানো হয়েছে।

ফটো – তাইয়েবা একাডেমি

তথ্যসূত্র:
১. সূরা: নিসা, আয়াত- ২২, ২৩ ও ২৪
২. সূরা: নূর, আয়াত- ৩১
৩. ফতওয়ায়ে শামী, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৯৯-১০৮ ও ৪০২-৪১০
৪. ফতওয়ায়ে আলমগিরী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৭৩-২৭৭
৫. বাদায়িউস সানায়ে, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩৯৬-৪০০

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *